টেকনাফ এখন ভাড়াটিয়া রোহিঙ্গাদের শহর!

টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি :

ফাইল ছবি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে সামরিক জান্তার তুমুল লড়াইয়ে প্রাণে বাঁচতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশে ঢুকছে। সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী এ রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়েছে কক্সবাজারের টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায়। এদের একটি বড় অংশ টেকনাফ পৌর এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকছে। কেউ কেউ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে।

গত সোমবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা ও লোকালয় ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। পৌর শহর ও আশপাশে ভাড়া দেওয়ার মতো বাড়ির সংখ্যা শতাধিক। এর প্রায় সবটাতেই এখন রোহিঙ্গা ভাড়াটিয়া। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, প্রতিটি এলাকা রোহিঙ্গায় ভরে গেছে।

তবে এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি। সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, অন্তত আট হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকেছে। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি-রোহিঙ্গা নেতাদের ভাষ্যমতে, রাখাইনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আধা লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে নতুন করে ঢুকেছে।

কয়েক দিন আগে রাখাইনের মংডুর নয়াপাড়া গ্রাম থেকে পালিয়ে টেকনাফে ঢুকেছে ফিরোজ কামাল ও তার পরিবার। গোদারবিলে একটি ভাড়া বাসায় আশ্রয় নিয়েছে তারা। টিনশেড ছয় কক্ষের ওই ভাড়া বাসায় আরও দুটি রোহিঙ্গা পরিবার রয়েছে।

ফিরোজ কামাল বলেন, ‘রাখাইনে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি যাচ্ছে। সেখানে থাকার অবস্থা নেই। খাবার নেই, থাকার ঘর নেই, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মির যুদ্ধে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে রোহিঙ্গা শিশু, নারীসহ বহু মানুষ। বিশেষ করে সীমান্তে জড়ো হওয়া লোকজনের ওপর ড্রোন হামলা হচ্ছে। এতে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর ভয়ে নৌকায় নাফ নদ পেরিয়ে এপারের টেকনাফের বরইতলী সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছি। আমাদের সঙ্গে আরও ১৪ জন রোহিঙ্গা ছিল। স্থানীয় দালাল ৫০ হাজার টাকা নিয়েছে। ক্যাম্পে থাকার জায়গা না পেয়ে ভাড়া বাসায় উঠেছি। মাসে ৪ হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিতে হচ্ছে। বিদেশে স্বজনদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে কষ্টে দিন পার করছি।’

 

নুর শাহেদ নামে আরেক রোহিঙ্গা টেকনাফের শিলবনিয়া পাড়ার এক প্রবাসীর বাড়িতে উঠেছেন পরিবার নিয়ে। তিনি বলেন, ‘রাখাইনে সুদাপাড়া গ্রামে জান্তা-আরাকান আর্মির মধ্য ব্যাপক যুদ্ধ চলছে। অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। আমরা এখানে পালিয়ে এসেছি। এখানে এক স্বজনের বাড়িতে উঠেছি। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যাওয়ার জন্য ভাবছি। আমার মতো অনেকে এখানে গ্রামগঞ্জে এবং ভাড়া বাসায় আশ্রয় নিয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন করে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার একটি বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছে ভাড়া বাসায়। টেকনাফের শিলবনিয়া পাড়া, নাইট্যংপাড়া, গোদারবিল, পুরান পল্লানপাড়া, উপজেলা, নাজিরপাড়া, সাবরাং, দক্ষিণ জালিয়াপাড়া, কায়ুখখালী পাড়া, ইসলামাবাদ, মৌলভীপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, হাতিয়ার ঘোনা, নতুন পল্লানপাড়া ও অলিয়াবাদে ভাড়াটিয়া হিসেবে রোহিঙ্গা পরিবারের দেখা মিলেছে।

আলিয়াবাদের একটি ভাড়া বাসার মালিক প্রবাসী মো. ইয়াছিন বলেন, ‘বিদেশে বসবাস করার কারণে এলাকার অনেক লোকজন অপরিচিত। কিছুদিন আগে দুটি পরিবার আমার ভাড়া বাসায় উঠেছিল। কিন্তু তারা যে রোহিঙ্গা ছিল, সেটি আমার জানা ছিল না। ফলে বিজিবি তাদের (রোহিঙ্গা) ধরে নিয়ে যায়। এর পর থেকে আমি আর কোনো রোহিঙ্গা পরিবারকে বাসা ভাড়া দিইনি।’

টেকনাফ পৌরসভার শিলবনিয়া পাড়ার একটি দোকানের কর্মচারী নুরুল ইসলাম জানান, আমার সামনে যেসব বহুতল ভবন রয়েছে কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে রোহিঙ্গাদের যাতায়াত বেড়েছে। অনেকে এসব ভবনে ভাড়া থাকছে। তাদের কারণে বাসা ভাড়াও বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার অনেকে ক্যাম্পে চলে গেছে।

অনেক আগে আসা রোহিঙ্গারা জমি কিনে ঘরবাড়িও করছে বলে নুরুল ইসলাম দাবি করেন। তিনি দ্রুত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে পাঠাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, এটা সত্য যে, আমার এলাকাসহ বিভিন্ন গ্রামে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে। অনেকে ভাড়া বাসায় থাকছে। এসব বিষয় আমি আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে একাধিকবার অবহিত করেছি। আমরা স্থানীয় বাসিন্দারা অনিরাপদ বোধ করছি। কেননা, ওপার থেকে অনেক সশস্ত্র সন্ত্রাসী পালিয়ে আসার খবর পেয়েছি। এখনই ব্যবস্থা না নিলে সামনে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই দেশের দালালের মাধ্যমে ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা পারাপার করা হচ্ছে। সীমান্তের ১৬টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে দালালরা। পয়েন্টগুলো হচ্ছে, বান্দারবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, তুমব্রু, টেকনাফ সীমান্তের জাদিমুড়া, কেরুনতরী, বরইতলী, নাইট্যং, চৌধুরীপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, নয়াপাড়া, মেরিন ড্রাইভের মহেশখালিয়া পাড়া, তুলাতুলি ঘাট, শাহপরীর জালিয়াপাড়া ও গোলারচর।

সীমান্তে দায়িত্বে থাকা সরকারি এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে একটি বিশেষ পরিস্থিতি যাচ্ছে। নাফ নদ সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্মি ক্যাম্প অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন, টেকনাফ শহরসহ রোহিঙ্গারা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। অতি দ্রুত যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের জনবল বাড়াতে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।

অনুপ্রবেশ বিষয়ে জানতে চাইলে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আমির জাফর বলেন, ‘সীমান্ত পেরিয়ে ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া নতুন রোহিঙ্গাদের অবস্থান পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তারা আমাদের মূল চেক পয়েন্ট দিয়ে ঢোকেনি। আমরা রোহিঙ্গা পারাপারের দালালদের খুঁজছি। ধরার চেষ্টা করছি।’
সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের প্রতিহত করা হচ্ছে জানিয়ে বিজিবির টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যাতে নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সীমান্তে টহল জোরদার রেখেছি।’